জঙ্গি কর্মকাণ্ডে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭২ ছাত্র-শিক্ষক

গত প্রায় সাড়ে তিন বছরে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কমপক্ষে ৭২ জন ছাত্র ও শিক্ষকের বিরুদ্ধে জঙ্গি কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেছে। পুলিশের গ্রেপ্তার ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার হওয়ার সূত্রে এসব নাম প্রকাশ পায়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য সংগ্রহ এবং সেগুলো পর্যালোচনা করে পাওয়া এই সংখ্যাটি উদ্বেগজনক।

তবে নিষিদ্ধ সংগঠনে জড়িত এবং গোপন কার্যক্রমে অংশ নেওয়া ছাত্র-শিক্ষকদের মোট সংখ্যা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা কারও কাছে নেই। এত দিন উগ্রবাদিতায় কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম শোনা গেলেও সেখানকার শিক্ষার্থীদের কর্মকাণ্ড ও আর্থসামাজিক অবস্থার প্রকাশ ঘটতে শুরু করেছে।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত সাড়ে তিন বছরে উগ্রবাদে জড়িত হওয়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ৩৭ জন প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্র-শিক্ষকের নাম প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত অন্তত সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কমপক্ষে ৩৫ জন ছাত্র-শিক্ষক গ্রেপ্তার বা বহিষ্কৃত হয়েছেন।
যে কেউ জঙ্গি হতে পারে: সাম্প্রতিক বিভিন্ন ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, যেকোনো পরিবার, যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং যেকোনো মাধ্যমে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থী জঙ্গি হতে পারে। ধর্মের অপব্যবহার, শিক্ষার্থীর হতাশা, সামাজিক অবক্ষয়, পড়াশোনার চাপ, সুষ্ঠু সাংস্কৃতিক চর্চা না থাকা, পরিবারে মা-বাবার সঙ্গে সন্তানের দূরত্ব তৈরিসহ নানা কারণে তারা বিপথে যাচ্ছে। এ নিয়ে সমাজ ও পরিবারে কান পাতলে শোনা যায়, কী করলে সন্তান বিপথগামী হবে না, সেই পথ খুঁজছেন অনেকেই।
গ্রেপ্তার হওয়ার পর পুলিশের দেওয়া তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, খেলোয়াড় ছেলে যেমন ধর্মান্ধ হয়েছে, তেমনি ড্রাম বাজানো বা গানপাগল ছাত্রটিও একই পথে হেঁটেছে। জিহাদে উদ্বুদ্ধ হওয়ার দলে চিকিৎসক, শিক্ষক, প্রকৌশলী যেমন আছেন, তেমনি মোনাশের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রও অন্ধকার পথে পা বাড়িয়েছেন। কওমি মাদ্রাসায় পড়ে কেউ বিভ্রান্ত হচ্ছেন আবার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েও কেউবা ওই পথে যাচ্ছেন।
সরকারের একজন প্রতিমন্ত্রীর ভাতিজা এবং শিক্ষকের ছেলে সাদ আল নাহিদ ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিনকে হত্যাচেষ্টার আসামি। আবার সরকারি দলের এক নেতার ছেলে রোহান ইবনে ইমতিয়াজ গুলশান হামলায় নিহত হন। এর আগে বিচারপতির সন্তান আসিফ আদনান, চিকিৎসক দম্পতির সন্তান ওয়াদুদ জুম্মন গ্রেপ্তার হয়েছেন উগ্র সংগঠনে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগে। সাবেক সেনা কর্মকর্তার ছেলে আজওয়াজ ও সাবেক নির্বাচন কমিশনারের ছেলে ক্লোজআপ তারকা তাহমিদ রহমান সাফির নাম এসেছে উগ্রবাদী হিসেবে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা বলছেন, উগ্র কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার পেছনে দূরবর্তী কারণ বিদেশি রাজনীতির প্রভাব। এটা নিয়ে পরিবার বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের খুব একটা করণীয় নেই। তাঁদের মতে, নিজের সন্তানকে সামাল দেওয়ার প্রথম দায়িত্ব পরিবারের। কিন্তু কখন যে সন্তান ভুল পথে পা বাড়াচ্ছে, তা পরিবারও অনেক সময় বুঝতে পারে না।
গুলশান হামলায় জড়িত সন্দেহে নিহত এক তরুণের শিক্ষিত মা প্রথম আলোকে বলেন, ‘পৃথিবীতে এমন কোন মা আছে, যে চায় তার সন্তান বিপথগামী হয়ে এভাবে মারা যাক? তবে এটা যেমন চাইনি, তেমনি ওকে সঠিক পথে রাখতে পারিনি, এটাও সত্য।’ ওই তরুণের বাবাও জানান, সন্তানকে তিনি যথেষ্ট সময় দিলেও তাতে কাজ হয়নি।
পুলিশের জঙ্গি দমন ও আন্তদেশীয় অপরাধ প্রতিরোধ টিম বলছে, উগ্রতার হাতেখড়ি হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই। এই বিভাগের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন, পেশাগত অভিজ্ঞতায় তাঁরা দেখেছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই জঙ্গিবাদের সূচনা হচ্ছে। পরিবার অনেক সময় এটা জানতে পারে না।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই অভিযোগ পুরোপুরি মানতে নারাজ। সমালোচনার কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তারা চাপা গলায় বলছেন, কোনো প্রতিষ্ঠানই ধর্মীয় উগ্রবাদ হয়ে ওঠার শিক্ষা দেয় না। বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতি শেখ কবির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র ও কতিপয় শিক্ষকের জন্য ঢালাওভাবে সবাইকে দায়ী করা হচ্ছে। এর পরিণতি উচ্চশিক্ষার বিকাশমান এই খাতে বিপর্যয় ডেকে আনবে।
শিক্ষকের হাত ধরে উগ্রবাদিতা: অনুসন্ধানে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ধর্মীয় উগ্রবাদিতা শুরু হয়েছে একশ্রেণির শিক্ষকের মাধ্যমে। হিযবুত তাহ্রীরের কর্মকাণ্ড বিকাশে তাঁদের সম্পৃক্ততা অনেকটাই পরিষ্কার ও প্রতিষ্ঠিত। এ প্রসঙ্গে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, নর্থ সাউথসহ বেশ কয়েকটি দৃষ্টান্ত রয়েছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, যেসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উগ্রবাদীরা বেরিয়ে আসছে, ধরে নিতে হবে ওই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের শিক্ষা দেওয়ার মতো মুরব্বি রয়েছেন। এ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মেধাবী শিক্ষক পাওয়া গেলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক ক্ষেত্রে মানবিক বোধসম্পন্ন শিক্ষক পাওয়া যাচ্ছে না। পরিবারের পর শিক্ষক বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষক তাকে পরিবর্তন করতে পারেন, তার পরিবর্তনের পক্ষে কাঁটাও হতে পারেন।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, হিযবুতের প্রধান চার নেতার দুজন হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষক মহিউদ্দিন আহমেদ ও সৈয়দ গোলাম মাওলা। গোলাম মাওলা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিচ্ছেন। আর গত ১৪ জুলাই এক বিবৃতিতে মহিউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, হিযবুতের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা নেই।
সাম্প্রতিক সময়ে আরেক শিক্ষক হাসনাত করিমের সঙ্গে হিযবুতের সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছে। তিনি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১২ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। গুলশানে রেস্তোরাঁয় হামলার সময় তিনি সেখানে ছিলেন এবং সন্দেহের তালিকায় থাকা ওই শিক্ষক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে এখনো আছেন বলেই পরিবারের দাবি।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হিযবুতের কর্মকাণ্ডের শুরু নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে। খিলাফত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শান্তিপূর্ণ ওই মতবাদ ধীরে ধীরে সহিংস হয়ে ওঠে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, প্রথমে সহিংসতা ও খুনোখুনি না থাকলেও পরে হয়তো ওরা দেখেছে, এসব শান্তির কথা বলে লাভ নেই। তাই এর কর্মীরা সহিংসতার দিকে পা বাড়িয়েছে। এদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক কোনো চক্রের যোগসূত্র প্রতিষ্ঠা হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, হিযবুতের কর্মকাণ্ড, মতবাদ ও চেতনা বিকাশ হয়েছে প্রযুক্তিজ্ঞানে সমৃদ্ধ মেধাবী শিক্ষক ও ছাত্রদের মাধ্যমে। এর কারণ অনুসন্ধান করে জানা যায়, হিযবুতের মতবাদ বোঝার সক্ষমতা সবার নেই।
অসম দৌড়ে হতাশ ও ক্লান্ত শিক্ষার্থী: প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অনেক টাকার বিনিময়ে পড়াশোনা, একটি ভালো ফল, ভালো চাকরি—এসব অসম দৌড়ে হতাশ ও ক্লান্ত হয়ে পড়ে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ। ভালো মানের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টারের চাপে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী পিষ্ট হচ্ছে।
স্নাতক পর্যায়ে বিষয়ভেদে ১৩০ থেকে ২০০ ক্রেডিট নিতে হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশ সম্পর্কে থাকে মাত্র ৪ ক্রেডিট। স্নাতক পর্যায়ের একজন শিক্ষার্থী ৪ ক্রেডিটের এই শিক্ষা নিয়ে দেশ, সমাজ ও পরিবেশ সম্পর্কে কতটা জানতে পারেন, সেই প্রশ্নও শিক্ষাবিদদের।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত পাঁচজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী বিষয় পছন্দ করছেন ইচ্ছার বিরুদ্ধে, যা তাঁর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আড্ডা, সাহিত্যচর্চা, বিতর্ক, রক্তদান—এসব কিছু আছে না থাকার মতোই। একাধিক শিক্ষার্থী জানান, তাঁদের চাকরি মেলায় (জব ফেয়ার) যেতে উদ্বুদ্ধ করা হয়, বিদেশি কোনো বক্তাকে ডেকে তাঁর বক্তৃতা শোনানো হয়।
সাম্প্রতিক তিনটি বড় ঘটনার পর বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে, সন্তানকে ভালো বা অভিজাত প্রতিষ্ঠানে পড়ানো ভুল কিছু নয়। তবে তারা কখন, কী করছে, পড়াশোনার চাপ সামলাতে পারছে কি না, কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে—এসব খোঁজখবর নেওয়াটাও জরুরি। তাঁদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, ধনী পরিবারের সন্তান চাঁদাবাজি বা টেন্ডারবাজির রাজনীতিতে সাধারণত আগ্রহী হয় না। ছাত্রলীগ বা ছাত্রদল এমনকি বাম ছাত্রসংগঠনের রাজনীতিও তাদের টানতে পারছে না। কিন্তু কৈশোর বা তরুণ বয়সে অ্যাডভেঞ্চার আর নানা কৌতূহল তাদের তাড়া করছে, যেখানে আবেগটাই বেশি কাজ করে। এই আবেগের অপব্যবহার করে ফায়দা নিচ্ছে মতলববাজেরা।
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, জ্ঞান সেখানে গভীরভাবে চর্চা হয় না। সেখানে জ্ঞান একমুখী ও পেশাদারি হয়। এ ছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সুষ্ঠু সংস্কৃতির চর্চা বা অনুশীলন হচ্ছে না। ওইসব প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ বা ছাত্রদের রাজনৈতিক সচেতনতা না থাকাটাও একটা বড় ঘাটতি বলে তাঁর মত।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ইশফাক এলাহী চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, লেজুড়ভিত্তিক দলীয় রাজনীতি কেউ করুক বা না করুক, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক সচেতনতা থাকতেই হবে। নইলে এভাবে ‘মগজধোলাই’ করাটা সহজ হয়।
প্রকৃত ধর্মীয় শিক্ষা পায় না: ধর্মীয় ব্যক্তিত্বরা বলছেন, বিত্তবান পরিবারের সন্তানদের বেশির ভাগই সঠিক ধর্মীয় শিক্ষা পায় না। তাদের কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর ধর্ম নিয়ে নতুন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। সেখানে ধর্মান্ধ বন্ধু ও মতলবি শিক্ষকের পাল্লায় পড়ে ধর্মান্ধ হয়ে ওঠে।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজাল প্রথম আলোকে বলেন, প্রকৃত ধর্ম কাউকে বিভ্রান্ত করে না। তাঁর মতে, ইসলামের নামে যেকোনো বই সন্তানদের পড়তে দেওয়া উচিত নয়। একইভাবে ইসলাম নিয়ে কম জানাশোনা ব্যক্তিদের ব্যাখ্যা-বক্তৃতা শোনাও অনুচিত। তাঁর মতে, জঙ্গিবাদ মাদকাসক্ত হওয়ার মতো, সেখান থেকে সরিয়ে আনা বেশ কঠিন। এই পরিস্থিতিটা পরিবারের জন্যও বিব্রতকর।
যেসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম এসেছে: প্রকাশ হওয়া নামগুলোর মধ্যে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ ২৬ জন ছাত্র-শিক্ষক আছেন। উগ্রপন্থায় জড়িত থাকায় সাম্প্রতিক সময়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্র রোহান ইবনে ইমতিয়াজ ও তাহমিদ রহমান সাফির নাম এসেছে। আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের (এআইইউবি) এ টি এম তাজউদ্দিন নামে যে ব্যক্তির নাম নিখোঁজ জঙ্গি তালিকায় আছে, তিনি কম্পিউটার বিজ্ঞানের প্রাক্তন ছাত্র ছিলেন।
ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের (আইইউবি) সাবেক শিক্ষক ছিলেন হিযবুতের অন্যতম নেতা মহিউদ্দিন আহমেদ, যিনি পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন।
উগ্রবাদিতায় জড়িত থাকার অভিযোগে গত বছর গ্রেপ্তার হন আইইউবি থেকে পাস করা প্রকৌশলী ফিরোজ মো. তমাল ও সদ্য বন্ধ ঘোষিত দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল্লাহ।
আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) মিডিয়া শাখার প্রধান মোরশেদ আলম ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার সায়েন্সে পড়াশোনা করেছেন। সম্প্রতি কুমিল্লা থেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক প্রাক্তন ছাত্র ও হিযবুতের সদস্য রফিকুল ইসলাম মিয়াজী। নিখোঁজ তালিকায় থাকা এক ছাত্র আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রামের ছাত্র।
হরকাতুল জিহাদের (হুজি) সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০১৪ সালে গ্রেপ্তার হন প্রাইম ইউনিভার্সিটির ছাত্র ওমর ফয়জুল। গত ১৯ জুলাই সিলেটের লিডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মাহমুদ চৌধুরীকে উগ্রবাদী সন্দেহে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তবে এগুলোর বাইরেও বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে সন্দেহ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলার পর ১৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ৯টি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলসহ ২৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কঠোর নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ প্রথম আলোকে বলেন, কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেলে এবং তার প্রমাণ মিললে প্রয়োজনে নিবন্ধন বাতিল করা হবে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ৬(১০) ধারা অনুযায়ী, সন্ত্রাসী বা জঙ্গি তৎপরতায় অংশগ্রহণ বা পৃষ্ঠপোষকতা করলে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ বাতিল হবে। এ ছাড়া পাঁচ বছরের জেল, ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় শাস্তি হতে পারে।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উগ্রবাদিতা: উগ্রবাদে জড়িত থাকায় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গত সাড়ে তিন বছরে কমপক্ষে ৩৫ জন ছাত্র-শিক্ষক গ্রেপ্তার বা বহিষ্কৃত হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাত ছাত্র, দুই শিক্ষক ও একজন ল্যাব সহকারী আছেন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আছেন ১১ জন। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র রয়েছেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত দুটি কলেজের দুজন ছাত্রেরও নাম এসেছে।
ইউজিসির চেয়ারম্যানের মতে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জঙ্গি-সম্পৃক্ততার অভিযোগ বেশি। গতকাল রোববার সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে গণমাধ্যমের তথ্যের বরাত দিয়ে চেয়ারম্যান বলেন, ৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৩ জঙ্গির খোঁজ পাওয়া গেছে, এদের মধ্যে ৪টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮ জন এবং ৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫ জন ছাত্র রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট ও বাণিজ্য অনুষদ ঘিরে রয়েছে হিযবুতের কার্যক্রম। মহিউদ্দিন আহমেদ ও গোলাম মাওলা ছাড়া আরও কিছু শিক্ষক ওই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। হিযবুতের সঙ্গে জড়িত থাকায় গত বছর বহিষ্কৃত সাত শিক্ষার্থীর ছয়জনই বাণিজ্য অনুষদের বিভিন্ন বিভাগের ছাত্র।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায়ই হিযবুত তাহ্রীরের ব্যানার, পোস্টার সাঁটানো হয়। গত বছরের ডিসেম্বরে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের তিন ছাত্রকে বহিষ্কার করা হয়েছে। প্রক্টর মো. আলী আজগর চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, কিছু শিক্ষক ও ছাত্র উগ্রবাদে সম্পৃক্ত হলেও প্রকাশ্যে তাঁদের কর্মকাণ্ড নেই।
বুয়েটকে ঘিরে ধর্মীয় উগ্রবাদের অভিযোগ বহুদিনের। গত বছরের আগস্টে ১১ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হয়। বুয়েটের তিনজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে ধারণা পাওয়া যায়, সেখানকার কিছু মেধাবী শিক্ষার্থী ধর্মান্ধ হয়ে ওঠেন মূলত হতাশা থেকে। তাঁদের মতে, এই প্রতিষ্ঠানে সেরা মেধাবীরাই সবকিছুতে অগ্রাধিকার পান। কিন্তু সেখানে ভর্তির পর যে শিক্ষার্থী ক্লাস করেন না, হতাশায় ডুবে যান, তাঁর জন্য সময় দেওয়া শিক্ষক ও স্বজনের অভাব দেখা যায়।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, বুয়েটে ভর্তির পর সব শিক্ষার্থীর ফল ভালো হয় না। শিক্ষাজীবনে সেরা হয়ে আসা ছাত্রদের একটি অংশ সেখানে গিয়ে হতাশ হয়ে কেউ কেউ প্রাইভেট টিউশনি করেন। পড়াশোনা ভালো না হলেও তাঁরা উগ্রবাদে জড়ান না। কিন্তু আরেকটি অংশ হতাশা থেকে উগ্র হয়ে ওঠেন।
বুয়েটের অধ্যাপক মো. কায়কোবাদ প্রথম আলোকে বলেন, যার ধর্মের জ্ঞান কম, তাকে বিভ্রান্ত করা সহজ। সেটাই হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে। তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের ছেলেমেয়েরা আশার আলো পাচ্ছে না। সামনে রোলমডেল পাচ্ছে না। সুশাসনের অভাব দেখে নিজেকে নানা রকম অন্যায়ের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলছে।’
সাম্প্রতিক সময়ে প্রকৌশল এবং ব্যবসায় প্রশাসনের মতো বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নেওয়া তরুণদের উগ্র তৎপরতায় সংশ্লিষ্টতা বেশি দেখা যাচ্ছে। এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, তাঁরা অনলাইন জগতে বেশি থাকেন এবং তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে উচ্চপর্যায়ের চিন্তা করেন। এ কারণেই মোবাইল ও ইন্টারনেট হয়ে উঠেছে শক্তিশালী অস্ত্র, যার অপব্যবহার করছেন মেধাবী উগ্রবাদীরা।
নর্থ সাউথকে ঘিরে সমালোচনা: গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, উগ্র কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে এখন পর্যন্ত এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ও বর্তমান ২৬ ছাত্র-শিক্ষকের নাম সুনির্দিষ্টভাবে এসেছে। ২০১৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ব্লগার রাজীব হায়দারকে হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন সেখানকার সাতজন শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের সম্পৃক্ততা মূলত তখন থেকে প্রকাশ পেতে থাকে।
সর্বশেষ গুলশান, শোলাকিয়া ও কল্যাণপুরের ঘটনা, আরও হামলার হুমকি দিয়ে ভিডিও প্রকাশ এবং র্যা বের নিখোঁজ তালিকা—সব মিলিয়ে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষক-শিক্ষার্থীর নাম আসতে থাকে। গোয়েন্দা সংস্থা ও ইউজিসির পক্ষ থেকে নর্থ সাউথ কর্তৃপক্ষকে ৪০ ছাত্র-শিক্ষকের নাম দেওয়া হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রায় ২২ হাজার শিক্ষার্থী, ৭০০ পূর্ণকালীন এবং ৩০০ খণ্ডকালীন শিক্ষক থাকা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে দৃষ্টিনন্দন অবকাঠামো থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় কিছু ত্রুটি ধরা পড়েছে। উপাচার্য আতিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পড়া, শেখা, গবেষণা ও চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের যে অগ্রগতি, তা চাপা পড়ে যাচ্ছে কিছু ছাত্রের উগ্র কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার অভিযোগে, যদিও তাঁদের প্রায় সবাই প্রাক্তন।
গত ১৪ ও ১৬ জুলাই সরেজমিনে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদটির ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। নিরাপত্তাকর্মীরা জানালেন, নামাজের আগে মসজিদের দরজা খুলে দেওয়া হয়। নামাজ শেষ হলেই দরজায় তালা দেওয়া হয়। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯০টি সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি এম এ কাশেম প্রথম আলোকে বলেন, উচ্চশিক্ষার জাগরণ ঘটাতে নর্থ সাউথ যে অবদান রাখছে, সেটি চাপা পড়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে নর্থ সাউথ জর্জ ওয়াশিংটন, জন হপকিনস এবং ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডের সঙ্গে উচ্চশিক্ষা বিষয়ে চুক্তি করেছে। কিছু ছাত্রের উগ্রবাদিতার সূত্র ধরে এসব অর্জন ম্লান হতে পারে না।
বীরত্ব দেখানোর বয়স: বিশ্লেষণে দেখা যায়, একধরনের বীরত্ব বা বীরপুরুষের ভাব তরুণ বয়সে কাজ করে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ প্রচারমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখে তরুণদের কেউ কেউ প্রভাবিত হচ্ছেন।
বিশ্বজুড়ে মুসলিম দেশগুলোতে বৃহৎ শক্তির নির্যাতনের ঘটনাগুলো তরুণদের সামনে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টির উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা হয়। এ নির্যাতনের বিরুদ্ধে ইসলামিক স্টেট (আইএস) বা অন্য উগ্রবাদীদের নৃশংসতা দেখে কেউ কেউ অনুপ্রাণিত হচ্ছেন। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তরুণেরা এতটাই অনুপ্রাণিত হয়েছেন যে মাদ্রাসার ছাত্র ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, নিম্নবিত্তের সন্তান ও অভিজাতের সন্তান একই মেসে থাকছেন, একই ধরনের নৃশংস কাজ করছেন। যারা কলকাঠি নাড়ছে, তারা এতটাই সফল যে সব পরস্পরবিরোধী চরিত্র ও অবস্থান এক সুতায় গেঁথে ফেলছে।
সর্বশেষ কল্যাণপুরে যে নয় জঙ্গিকে হত্যা করা হয়, তাঁদের আটজনের মধ্যে তিনজন নর্থ সাউথের এবং একজন সরকারি কলেজের ছাত্র। এ ছাড়া দুজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ও একজন মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছেন এবং আরেকজন নির্মাণশ্রমিক।
উগ্রবাদিতা নিয়ে সাম্প্রতিক এই তৎপরতাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন কেউ কেউ। রাজনীতিবিদদের অনেকেই মনে করছেন, জঙ্গিবাদ সমাজের ওপরতলায় আঘাত করায় সবার টনক নড়েছে, সমাজে ঝাঁকুনি লেগেছে। এতে সরকার, সমাজ ও পরিবারে এ-বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসবে।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন প্রথম আলোকে বলেন, জঙ্গিবাদের ভয়াবহতা ও শিকড় সম্পর্কে কয়েক বছর ধরে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্ক করা হচ্ছিল। কিন্তু এটাকে যতটা এবং যেভাবে গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল, তা হয়নি বলেই পরিস্থিতি আজকের এ ভয়াবহ অবস্থায় এসে ঠেকেছে।












No comments:

Post a Comment